মহিলারা ঘরে বসে এক সময় কাপড় সেলাই করতেন। সেই গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে বেরিয়েছেন তারা। ফ্যাশন জ্ঞান ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করছেন ফ্যাশনেবল পোশাক। তাদের নিরলস চেষ্টায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দেশীয় পোশাকের দোকান বা বুটিক শপ। নারী মেলার (আজিমপুর) কর্ণধার শামসুন নাহার বলেন, আমি উৎসবগুলোকে সামনে রেখে চলমান স্টাইল ও ঐতিহ্যের মিশেল ঘটিয়ে ফ্যাশনেবল পোশাক তৈরি করি। ক্রেতাদের রুচি, অবস্থা ও চাহিদা বিবেচনা করে পণ্যের মান, ডিজাইন ও মূল্য নির্ধারণ করি। আমরা যারা এই কাজের সাথে আছি, তাদের যেমন মানসম্মত পোশাক ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, তেমনি বিদেশী পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। কাজটি চ্যালেঞ্জিং এবং আমি পছন্দ করি। আমার শোরুমে বেডশিট, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও বেবি আইটেম আছে। এ ছাড়াও মহিলাদের কাপড় সেলাইয়েরও অর্ডার নেয়া হয়। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। কাপড় কেনা, ডিজাইন, তৈরি সবই আমি নিজে করে থাকি।
মিরপুর ব্লক সি-তে অবস্থিত শ্রেয়া ফ্যাশন হাউজের কর্ণধার শিবানী বিশ্বাস। প্রায় দুই বছর হলো এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন। তার হাউজের পোশাকগুলো ক্রেতাদের আকর্ষণ করে। এ রকম ছোট-বড় অনেক ফ্যাশন হাউজ দেখা যায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় এবং এগুলোতে শুধু ক্রেতাসমাগমই হয় না, মূলত অনেক নারীর কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হয়।
আরেকটি ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা নারীরা এগিয়ে, সেটি হলো বিভিন্ন রকম হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়কেন্দ্র, রান্নার ট্রেনিং সেন্টার ও বিউটিপার্লারের ওপর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ফরিদা আলম এমনই একজন উদ্যোক্তা, যিনি সাত বছর ধরে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছেন তার শ্রম ও মেধার সমন্বয়ে। সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি তার শোরুমে। অপ্সরা স্কিন কেয়ার অ্যান্ড হারবাল বিউটিপার্লার, অপ্সরা লেডিস টেইলার্স ও অপ্সরা বুটিক অ্যান্ড কসমেটিকস হাউজ। অপ্সরার কর্ণধার ফরিদা আলম বলেন, অপ্সরা বুটিক অ্যান্ড কসমেটিকস হাউজে মহিলা ও শিশুদের সব ধরনের পোশাক, কসমেটিকস, জুয়েলারি, শোপিস ও শিশুদের খেলনা পাওয়া যায়। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী আমি এসব পণ্য সরবরাহ করি। অপ্সরা লেডিস টেইলার্স আমি নিজেই পরিচালনা করি। আমার বুটিকস থেকে পোশাক কিনে ক্রেতারা আমার টেইলারেই বানাতে দেন। মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত বলে মহিলারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন আর কাস্টমারদের চাহিদাও অনেক বেশি থাকে। বিউটিপার্লারও আমি সার্বক্ষণিক নিজে পরিচালনা করি। প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা করে সময় দেন তার প্রতিষ্ঠানকে। তার স্টাফ, কর্মচারী ও কাস্টমার সবাই তাকে খুব পছন্দ করেন। ঈদের আয়োজন ইতোমধ্যে সবার মাঝে শুরু হয়েছে। ঈদে বিক্রি হচ্ছে মোটামুটি ভালো। ঈদকে বর্ণিল ও আনন্দময় করতে এসব নারী উদ্যোক্তারা পোশাকে এনেছেন নানা রকম বৈচিত্র্য।
কারুকুঞ্জ বুটিকস অ্যান্ড হস্তশিল্প ট্রেনিং সেন্টার। পরিচালক তাহমিনা ফেরদৌসী (লতা) বলেন, মহিলা উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কারুকুঞ্জে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ট্রেনিং ফিও তুলনামূলক কম রাখা হয়। ট্রেনিং সেন্টারের পাশাপাশি আছে একটি বুটিক শপ। সেখানে ব্লক ও বাটিকের বিভিন্ন রকম পোশাক যেমনÑ সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি ও বেডসিট পাওয়া যায়। সুলভমূল্যে এসব বিক্রি হয়। আর যারা প্রশিক্ষণ শেষে কাজের অর্ডার নিতে আগ্রহী, ঘরে বসে কিছু করতে চান, তারা এই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্ডার নিয়ে বাসায় বসে কাজ করতে পারেন। উত্তরার সেক্টর-৪ এ দু’টি শাখায় মহিলা দ্বারা পরিচালিত অঙ্কনে রান্না প্রশিক্ষণ ও বিউটিপার্লারের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ঈদ উপলক্ষে রকমারি রান্নার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এখানে। ঈদের দিন খাবারের স্বাদ ও বৈচিত্র্য আনতে, অতিথি আপ্যায়নে সবাই চায় প্রশংসা কুড়াতে, সেই লক্ষ্যেই এসব প্রতিষ্ঠানের মহিলা উদ্যোক্তারা দিনরাত পরিশ্রম করেন। রন্ধনশিল্পী আফরোজা খানম মুক্তার প্রশিক্ষণ অ্যাকাডেমিতে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ ও রান্না প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ঈদের জন্য এগুলোতেও থাকে নানারকম ডিসকাউন্ট।
ঈদ উৎসবে পাড়া-মহল্লার বিউটিপার্লারগুলোও সরব হয়ে ওঠে। ঈদে সবাই চায় নিজেকে সুন্দর করে সাজাতে। সামর্থ্য অনুযায়ী সবাই চায় নিজেকে স্নিগ্ধ, সতেজ ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে। নারীদের সেই চাহিদাই পূরণ করতে এলাকার অলিগলিতে এমন অনেক অসংখ্য পার্লার গড়ে উঠেছে। কেউ বৃহৎ পরিসরে, কেউ বা ছোট্ট পরিসরে গড়ে তুলেছেন এসব প্রতিষ্ঠান। এতে নিজ এলাকায় অল্প খরচে মহিলারা সৌন্দর্য সেবা পাচ্ছেন অনায়াসে। বিউটিপার্লারগুলোর কর্ণধাররা বলেন, ঈদ পোশাকের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সবাই রূপচর্চার দিকেই বেশি নজর দেয়। পছন্দমতো চুলে রঙ করা, বিভিন্ন স্টাইলের হেয়ার কাটিং, রিবন্ডিং, ফেসিয়াল, আইভ্রু প্লাক ইত্যাদি মূলত ঈদের আগে মহিলারা করে থাকে। বিউটিপার্লার অপ্সরার কর্ণধার ফরিদা বলেন, ঈদকে সামনে রেখে বড় বড় বিউটিপার্লারের মতো আমরাও নানা রকম ডিসকাউন্ট দিচ্ছি। ঈদের দিন ঘনিয়ে আসছে, তাই আমাদের ব্যস্ততাও মোটামুটি বেশি। ঈদের আগের দিন সারা রাতই কাজ চলবে পার্লারে। এত কঠোর পরিশ্রম ও ব্যস্ততার পর আমরা ক্লান্তি অনুভব করি না। কারণ আমাদের কাছে মানুষ সৌন্দর্যের জন্য সেবা নিতে আসে। তাদেরকে সে সেবা দিতে পেরে আমরা আনন্দিত।
ঈদের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো মেহেদি। মেহেদি বাঙালি মেয়েদের ঈদ উৎসবকে সাজিয়ে তোলার অন্যতম অনুষঙ্গ। তাই সবার ঘরে ঈদ উপলক্ষে আসে মেহেদি। নানা রকম আল্পনায় হাতকে ক্যানভাস করে যারা আঁকেন তারা শিল্পী। এখন সামান্য সম্মানীর বিনিময়ে ঈদসহ নানা উৎসবে মেহেদি লাগিয়ে রাঙিয়ে তুলছেন হাত। মেহেদি নকশা করা এখন পেশা হিসেবে নতুন এক দিগন্ত খুলে দিচ্ছে নারীদের জন্য। এমনই একজন মেহেদি কারিগর উর্মী মাহবুব। ছোটবেলা থেকেই মেহেদি পরাতে ভালো লাগত। এখন নিজের চেয়ে অন্যের হাতে আল্পনা করতে ভালো লাগে, আনন্দ লাগে বেশি। মেহেদি পরানোর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তিনি। সেই থেকে এটাকে পেশা হিসেবে নেয়া। শ্যামলীতে নিজের বাসায় খোলেন মেহেদি ক্যানভাস নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
ঈদের মূল আকর্ষণ হচ্ছে রান্না। এই রান্নার কাজে নারীদের সাহায্য করতে আছে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যারা রান্নার কলাকৌশল, নতুন পদ্ধতি, পদ্ধতিগত দুর্বলতাগুলোর সমাধান ও স্বাস্থ্যগত দিকগুলো তুলে ধরে। দেশী-বিদেশী রকমারি খাবার তৈরি, তার পুষ্টিগুণ বিচার ও বিভিন্ন রেসিপি প্রচারের কাজে এগিয়ে এসেছেন এসব রন্ধনশিল্পী। রমজান ও অতিথি আপ্যায়নে, বিভিন্ন উৎসবে, ঘরোয়া বা নিমন্ত্রণের আয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপরই মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এটি হচ্ছে ক্যাটারিং ব্যবসা। এই ব্যবসায় উদ্যোক্তা বেশির ভাগই নারী। ঝর্না রহমান শখের হাঁড়ি ক্যাটারিংয়ের একজন কর্ণধার। তিনি বলেন, এখন হোমমেড ফুডের চাহিদা অনেক এবং প্রত্যেক মানুষের কাছেই জনপ্রিয়। বিভিন্ন খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট ও সুপারশপগুলোতে পাওয়া যায় হোমমেড ফুড। কর্মজীবী নারী ও গৃহিণীরা সময় বাঁচাতে এসবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। আগামী দিনগুলোতে বিশাল এক বাজার তৈরি হবে এ ক্ষেত্রে।
ভবিষ্যতে একটি বড় প্রতিষ্ঠান খোলার ইচ্ছা আছে আমার। সেখানে অনেক নারীর কর্মসংস্থান হবে। কিছু আত্মনির্ভরশীল তরুণ-তরুণী নিজের ফ্যাশন জ্ঞান ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে কোনোরকম শোরুম ছাড়াই নিজের বাসায় বা হলে নিজেই পোশাক ডিজাইন করে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারটি এখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ধরনের ব্যবসার প্রচারণার জন্য বিনাপয়সায় বিজ্ঞাপন মাধ্যম হিসেবে বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো। এভাবেই উৎসবকে ঘিরে এগিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
© বদরুন নেসা নিপা
^
^
নারী উদ্যোক্তা, উদ্যোক্তা, ব্যবসা, মহিলা উদ্যোক্তা,
No comments:
Post a Comment