ব্যবসা পারস্পরিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের মহান উদ্যোগ এবং জীবিকা উপার্জনের উত্তম মাধ্যম। ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় শুধু বৈষয়িক মুনাফা লাভের সুযোগই নয়; বরং তা মহান ইবাদতেরও পর্যায়ভুক্ত হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু সততা না থাকলে তা ইবাদত তো হবেই না, থাকবে না ব্যবসায়িক গণ্ডির মধ্যেও; পরিণত হবে প্রতারণায়।
ঈদের সময়; বিশেষ করে রমজানে দাম বাড়ানো একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের একাংশ রীতিমতো হিংস্রও হয়ে ওঠেন রমজানে। তাদের লুটেরা মনোভাবের কারণে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ না থাকলেও বাড়ান নিত্যপণ্যের দাম। মজুদকরণের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ইবাদতের মাসকে পরিণত করেন ‘মুনাফার’ উৎসবে। চাল-ডাল, ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুর ইত্যাদির দাম বাড়ান সাধ্যের বাইরে।
একটি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে যায় গোটা দেশের নাগরিক। আমাদের আশপাশের অনেকেই এখানে-ওখানে লোক দেখানো দান-সদকা করে দানশীলতার সুনাম কুড়ান। অথচ তারাই হয়তো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জনগণকে পনবন্দি করে রাখছেন। কোটি মানুষের টাকায় ভারী হচ্ছে তাদের পকেট। সিন্ডিকেটে জড়িত থেকে আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট দিয়ে রমজানে ইবাদত, দান-খায়রাতের অভিনয় রমজানের সাথে উপহাস করা ছাড়া কিছুই নয়।
যারা বেশি লাভের আশায় মজুদদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করবে ইসলাম তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। রাসূলুল্লাহ সা: তাদের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন বারবার। মজুদদারদের প্রতি আল্লাহ তায়ালাও ক্ষুব্ধ হন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্য মজুদ রাখল সে আল্লাহ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল, আল্লাহও নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে’ (মুসনাদে আহমাদ: ৮/৪৮১)।
মজুদদারির মাধ্যমে কোটিপতি হলেও তার ওপর গজব ও দারিদ্র্য অবধারিত। হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম উপায়ে সঙ্কট সৃষ্টি করে আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেবেন (ইবনে মাজা: ২/৭২৯)।
পক্ষান্তরে যারা মজুদদারি না করে স্বাভাবিকভাবে মুনাফা অর্জন করতে চান, আল্লাহ তাদের ব্যবসায় বরকতের দরজা খুলে দেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক দান করেন।
হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘অবাধ ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর পণ্য মজুদদকারী অভিশপ্ত হয় (ইবনে মাজা: ২/৭২৮)।
ড. ইউসুফ আল কারযাবী এ হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, একজন ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ক্রেতাকে বাধ্য করে অধিক মূল্যে বিক্রি করে যে লাভ করে তা খুবই সামান্য। কারণ তার পণ্য মজুদ করার কারণে তা বিক্রি হয়নি, পুঁজি আটকে আছে।
পক্ষান্তরে অন্য একজন ব্যবসায়ী পণ্য বাজারে নিয়ে এসে অল্প লাভে বিক্রি করে এই মূলধন দিয়ে আবারো পণ্য নিয়ে আসবে, তাতে বহু গুণ মুনাফা পাবে। এভাবে তার ব্যবসা চলতে থাকবে আর পণ্যদ্রব্য বেশি ক্রয়-বিক্রয় হওয়ার কারণে অল্প অল্প করে মুনাফার বিশাল অঙ্ক দাঁড়াবে (ইসলামে হালাল হারামের বিধান, পৃষ্ঠা-৩৫৫)।
প্রথম ব্যক্তির পুঁজি মজুদ করার কারণে আটকে গেছে, লাভ কিছু বেশি হলেও তা হয়েছে হারাম পন্থায়। বরকত না থাকায় লাভের দেহ থাকবে প্রাণহীন। আর দ্বিতীয় ব্যক্তিটি তার পুঁজিকে মজুদের মাধ্যমে আটকে না রেখে লাগাতার ব্যবসা করে যে লাভ করেছে তা হয়েছে হালাল পন্থায়। এতে থাকবে প্রভূত কল্যাণ। হালাল পন্থায় করায় ব্যবসা পরিণত হবে ইবাদতে। পরকালেও পাওয়া যাবে এর প্রতিদান।
মূলত দুনিয়ার জীবনে একটু বেশি সম্পদ উপার্জনের নেশাই (‘আরো চাই’ প্রবণতা) তাদের এহেন কাজের দিকে ঠেলে দেয়। অথচ সে হালাল পন্থায় থাকলেও তার জন্য নির্ধারিত সম্পদ তার কাছে আসবেই। হারাম পথে গিয়েও সে নির্ধারিত অংশের চেয়ে বেশি ভোগ করতে পারবে না কিছুতেই।
হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির উদ্দেশ্য হবে কেবল দুনিয়া অর্জন, আল্লাহ তার কাজকে এলোমেলো বিক্ষিপ্ত করে দেবেন। পেরেশানি সৃষ্টি করেন দেবেন। সম্পদের পাহাড় থাকলেও তার দু’চোখের সামনে দারিদ্র্য এনে দেবেন (‘আরো চাই আরো চাই’ প্রবণতা তাকে পাগল করে তুলবে)। অথচ পার্থিব সম্পদ সে ততটাই লাভ করতে পারবে, যতটা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। আর যার উদ্দেশ্য হবে আখিরাত আল্লাহ তায়ালা তার সবকিছুকে পরিপাটি গোছালো করে দেবেন। তার জীবন সুশৃঙ্খল হয়ে উঠবে। তার অন্তরে মুখাপেক্ষিহীনতা ঢেলে দেবেন। দুনিয়া বিনাশ্রমে তার কাছে আসবে (ইবনে মাজা: ২/১৩৭৫)। ‘আরো চাই’ প্রবণতা মানুষকে চরম সঙ্কটে ফেলে দেয়; হাজার কোটি টাকা থাকলেও তার অভাব শুধু বাড়তেই থাকে।
তাই প্রাচুর্যের চাহিদার লাগাম টেনে ধরার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআনুল কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এমনকি তোমরা কবরে পৌঁছে যাবে’ (সূরা তাকাসুর : ১-২)
রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর সাহাবিদের নির্মোহ জীবনযাপনে উৎসাহ দিয়েছেন। চাহিদার লাগাম টেনে ধরলে অন্যের সম্পদের প্রতি অন্যায় দৃষ্টিও থাকে না। হারামের সন্দেহ থাকলেই তা ত্যাগ করে।
হজরত আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘এক ব্যক্তি অন্যের কাছ থেকে একটি জমি ক্রয় করে তাতে একটি স্বর্ণের পাত্র পেল। ক্রেতা বিক্রেতাকে বলল, আপনার স্বর্ণ আপনি নিন। আমি তো আপনার কাছ থেকে কেবল জমি ক্রয় করেছি। স্বর্ণ তো ক্রয় করিনি। আর বিক্রেতা বললেন, আমি আপনার কাছে জমি ও জমির সংশ্লিষ্ট সবই বিক্রি করেছি। তাই এটা আপনার। তারা উভয়ে বিষয়টির মীমাংসা করার জন্য একজন বিচারকের দ্বারস্ত হলেন। বিচারক উভয়ের কথা শুনে বললেন, তোমাদের কি কোনো ছেলে-মেয়ে আছে? একজন বললেন, আমার ছেলে আছে। অপরজন বললেন, আমার মেয়ে আছে। বিচারক বললেন, তোমার ছেলেকে তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও। এরপর এই স্বর্ণ তাদের দিয়ে দাও’ (বোখারি : ৩/১২৮১; মুসলিম: ৫/১৩৩)।
মানুষের চাহিদা পুঁজি করে বেশি সম্পদ উপার্জনের নেশায় পণ্যের দাম বাড়ালে হাশরের ময়দানে বিন্দুমাত্রও ছাড় পাওয়া যাবে না। হজরত রিফা’আ রা: বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে বের হলাম। তিনি লোকেদেরকে সকাল বেলা বেচাকেনা করতে দেখলেন। তিনি তাদের ডাকলেন, হে ব্যবসায়ীরা! তারা রাসূলুল্লাহ সা:-এর দিকে মনোযোগে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকালে তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহাপাপী হিসেবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত’ (তিরমিজি : ৩/৫১৫; ইবনে মাজা : ২/৭২৬)।
আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবসায় সব ধরনের প্রতারণা মজুদদারি, মুনাফাখোরী বাদ দিলে এর প্রতিদানও নিশ্চিতভাবে মিলবে হাশরের ময়দানে। হজরত আবু সায়ীদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সাথে (তিরমিজি: ৩/৫১৫)। একজন ব্যবসায়ীর জন্য এর চেয়ে আশার বাণী আর কী হতে পারে!
তাই ব্যবসায়ীদের চাই একটি পরিকল্পনা করা, কিভাবে রমজানে ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় ব্যবসার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা যায়। দিনের বেলায় না খেয়ে যেমন পেটকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তেমনি ব্যবসায় হালাল-হারাম মেনে আদর্শ ব্যবসায়ী হওয়ার শপথ হোক রমজানে।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শাফিক মসজিদ,
বোর্ড বাজার, গাজীপুর
© nayadiganta
No comments:
Post a Comment