ব্যবসায় নতুন হোন আর পুরাতন, অথবা ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন বা যাচ্ছেন। তাদের জন্যই ব্যবসায় সফলতার দিকনির্দেশনা বা নিয়ম-কানুন, যার অত্যাবশ্যকীয়তা বা গুরুত্ব বলে শেষ হবার নয়।
পড়েই - করেই দেখুন না কি হয় !
প্রশ্ন : বন্ধুদের দেখাদেখি শুরু করেছিলাম ফ্যাশন ওয়্যারের বিজনেস। কিন্তু লাভ তো দূরের কথা দামি মার্কেটে সাজানো-গোছানো দোকানের খরচ ওঠাতেই ধার-দেনার অবস্থা। এখন কী করবো?
উত্তর : আপনি এখানেই ভুল করেছেন। ব্যবসা করতে গিয়ে হুজুগে মেতে ওঠার প্রবণতাটা আমাদের অনেকেরই আছে। সবাই যেখানে যাচ্ছে সে ব্যবসার পেছনেই আমরা ছুটি। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে, প্রতিটি পাত্রের যেমন একটা ধারণক্ষমতা আছে, তেমনি প্রতিটি খাত বা ব্যবসার চূড়ান্ত মাত্রা বা ধারণক্ষমতা আছে যার পরে আর ঐ ব্যবসায়ে বিস্তৃতির কোনো সুযোগ থাকে না। যারা প্রথমে যায়, তারাই মূলত লাভবান হয়। পরে যারা আসে তাদের আখেরে তেমন কিছুই জোটে না।
বাংলাদেশে যখন আশির দশকে প্রথম গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু হলো, আমি যেহেতু এস্ট্রলজি চর্চা করতাম, অনেককেই বললাম-গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি করুন। তারা বললেন যে, ‘কী! দর্জির দোকান দেবো আর বাড়ির মেড-সার্ভেন্টদের চাকরি দেবো’? তারা গার্মেন্টস ব্যবসায় গেলেন না। আর যারা গেলেন সেই প্রথম উদ্যোক্তারাই কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন।
যখন প্রথম কেউ একটা জিনিস শুরু করে, সবসময় মাখন সে-ই পেয়ে যায়। যেরকম-মোবাইলের প্রথম মাখন খেলো সিটিসেল, ১০ বছর। তারপরে মাখন যেটুকু ছিলো-গ্রামীণ। এখন হাড্ডি নিয়ে কামড়াকামড়ি হচ্ছে, তারপরেও আরো নতুন নতুন কোম্পানি আসছে। গ্রামীণ যা লাভ করে গেছে! একটু চিন্তা করে দেখুন যে, প্রতি মিনিটে কলরেট একসময় ছিলো- একটা জোনের মধ্যে চার টাকা, ইন্টারজোন হলে ১২ টাকা। তারপর তারা বললো, ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান মোবাইল ওয়ান রেট-সাত টাকা। এখন ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান মোবাইল ওয়ান রেট এক টাকার কম। তারপরও তো তারা লাভ করছে। তাহলে যখন সাত টাকা ছিলো, কী পরিমাণ লাভ করেছে? এটা কেন? যেহেতু তারা আগে এসেছে। অর্থাৎ ব্যবসার জন্যে প্রয়োজন নতুন আইডিয়া খুঁজে বের করা।
২০ বছর আগের কথা। এক যুবক ভুয়া আদমব্যাপারীর পাল্লায় পড়েছিলো। বিদেশে গেল, ওখানে গলাধাক্কা খেয়ে ফিরে এসে আমার সাথে দেখা করতে এলো। তাকে বললাম, আপনি কী করতে পারবেন? কী আছে আপনার? যা আছে তা নিয়েই শুরু করুন।
সে বললো, গ্রামে আমার এখনো একটা বাড়ি আছে, একটা পুকুর আছে। পুকুরের পাশে আমার বিঘাখানেক জমি আছে।
বললাম, চিন্তা করুন-এ থেকে কী করা যায়। খুব বুদ্ধিমান ছিলো সে। বললো, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। আমি কাউকে জানাতে পারছি না। যাকে বলি সে-ই বলে পাগল।
আমি বললাম, খুব ভালো। আমি তো এরকম পাগলদের খোঁজই করি সবসময়। সে বললো, আমার এই পুকুরটাকে দুই ভাগ করবো। একভাগে মাগুর মাছ চাষ করবো, আরেকভাগে ব্যাঙ চাষ করবো। এর সাথে কেঁচোর চাষ করবো। ব্যাঙের তো পা ছাড়া অন্য অংশ কাজে লাগে না। এগুলো মাটিতে পুঁতে দেবো দুই পুকুরের মাঝখানে, যেখানে কেঁচো থাকে। কেঁচো এগুলো পছন্দ করে, কেঁচো এগুলো খাবে। আবার, ব্যাঙ কেঁচো খুব পছন্দ করে। ব্যাঙ কেঁচো খায়। ব্যাঙকে কেঁচো খাবে আবার কেঁচোকে ব্যাঙ খাবে। একটা খাদ্যচক্র। ব্যাঙাচি হচ্ছে মাগুর মাছের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। প্রচুর ব্যাঙাচি হবে, ওদেরকে মাগুর মাছ খাবে।
তার যে টাকা নষ্ট করেছিলো সেই টাকা দুই বছরে উসুল হয়ে গেল। ব্যাঙাচি খেলে মাছ খুব দ্রুত বাড়ে। মাগুর মাছ খুব দ্রুত বাড়তে লাগলো। মাগুর মাছ বিক্রি করছে, ব্যাঙের পা বিক্রি করছে। ব্যাঙের অবশিষ্টাংশ মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে। সেটা খেয়ে কেঁচো বড় হচ্ছে। কেঁচো খেয়ে ব্যাঙ বড় হচ্ছে। ব্যাঙাচি খেয়ে মাগুর মাছ বড় হচ্ছে।
চার/ পাঁচ বছর পরে আবার সে এলো, চমৎকার চেহারা। বললো, এখন আমার কোনো অভাব নেই। এখন আমি চিন্তা করছি নির্বাচনে দাঁড়াবো।
আমি বললাম, নির্বাচন করে কী হবে? সে বললো, এখন তো আল্লাহর রহমতে টাকাপয়সার অভাব নাই। আমি বললাম, টাকাপয়সা বাড়াতে থাকেন। মানুষের কিছু উপকার করেন। সে বললো, উপকার করার জন্যেই তো নির্বাচন। আমি বললাম, নির্বাচন করে উপকার করতে পারবেন না। নির্বাচন করতে গেলেই আপনার উপকারের পরিমাণ কমে যাবে। কারণ যারা আপনাকে নির্বাচিত করবে তখন তাদের ফুট-ফরমায়েশ, তাদের মনোরঞ্জন করতে করতে আপনার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।
চিন্তার নতুনত্ব তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, সে এখন প্রচুর টাকার মালিক। নির্বাচন করতে গেলেই তো অনেক টাকা লাগে। নষ্ট করার মতো এত টাকা তার হয়ে গেছে।
ব্যবসা যখন করবেন, আপনাকে এই বুদ্ধি, এই নতুনত্ব, এই মেধাটাকে প্রয়োগ করতে হবে। চিন্তা করতে হবে-নতুন কোন ক্ষেত্রে তা করা যায়। ছোট হোক, কিন্তু নতুন ক্ষেত্র। কারণ সেখানে আপনিই প্রথম-দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন প্রতিযোগিতা ছাড়া।
প্রশ্ন : আমার এক পরিচিতজন আছে, তার ভাগ্য খুব ভালো। খরিদ্দাররা তার দোকান ছাড়া কেনে না। আমার কেন যেন এ ব্যাপারে ভাগ্য খুব খারাপ।
উত্তর : এটা ভাগ্য নয়। এটা তার নিয়ত, তার দৃষ্টিভঙ্গি। আসলে একজন ব্যর্থ এবং সফল ব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য হলো-ব্যর্থ ব্যবসায়ী চিন্তা করে ‘কত দ্রুত লাভ করা যাবে’। আর সফল ব্যবসায়ী লাভ কম করে। সে তার ক্রেতার ওপর গুরুত্ব দেয়, যাতে এ লোকটি সবসময় এই দোকান থেকে কেনে। সফল ব্যবসায়ী অল্প লাভ করে বেশি জিনিস বিক্রি করে আর ব্যর্থ ব্যবসায়ী অল্প জিনিস বিক্রি করে বেশি লাভ করতে চায়।
অল্প জিনিস বিক্রি করে আপনি যদি বেশি লাভ করতে চান তবে আপনার ব্যবসা টিকবে না। একবার ঠকবে, দুইবার ঠকবে, তৃতীয়বার ক্রেতা আর আপনার কাছে আসবে না। এ প্রসঙ্গে একজন সফল ব্যবসায়ী একবার বলছিলেন, সাধারণ ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে লাভ করতে চায়। বিক্রি করে আসলে লাভ করা যায় না। লাভ করতে হয় কেনার সময়।
সন্তুষ্ট হলে আপনার ক্রেতারাই নতুন ক্রেতা নিয়ে আসবে। আর ক্রেতার সন্তুষ্টি নির্ভর করছে আপনার ওপর। এক তো হচ্ছে আপনার পণ্যের মান হতে হবে এমন যাতে ক্রেতা মনে করতে পারেন ভালো পণ্য কিনতে হলে আপনার দোকানই একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। আপনার কাছেই তাকে আসতে হবে। এই যে মামা পেঁয়াজু-প্রথম সে শুরু করেছিলো একটা টং দিয়ে। কিন্তু এখন শুধু পেঁয়াজু বিক্রি করে তার ঢাকা শহরে চারটা বাড়ি। কেন পেরেছে? ক্রেতার সন্তুষ্টি। যে কিনছে, সে নিজেকে প্রতারিত মনে করছে না। যেমন, এখনকার কিছু চাইনিজ জিনিসপত্র একবার কিনলে আর দ্বিতীয়বার কেনার ইচ্ছে হয় না। এর মধ্যে একজন এসে বললো, আট গিগাবাইটের পেনড্রাইভ একবার ঢোকালে আর দ্বিতীয়বার চলে না। চীনারা যে মার্কেট দখল করছিলো-এই দুই নম্বর কোম্পানিগুলো চীনাদের মার্কেটের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, আপনার দোকানে যদি আরো কর্মচারী থাকে, ক্রেতার প্রতি তাদের আচরণ কেমন হচ্ছে সেদিকেও আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন, আপনার কর্মচারীরা কি ক্রেতাকে যথাযথ সম্মান দেয়? মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনে? আন্তরিকভাবে জিনিস দেখায়? কোনো কারণে ক্রেতা পণ্য কিনতে না চাইলে তাকে কি কটু মন্তব্য করে? দোকানে ক্রেতা এলে আপনি এবং আপনার কর্মচারীরা কি খুশি হন? শুকরিয়া আদায় করেন?
অতএব দোকানের বিক্রি বাড়াবার জন্যে এই বাস্তব পদক্ষেপগুলো নিন। সবসময় ইতিবাচক থাকুন। সাধ্যমতো দান করুন। দেখবেন, ভাগ্য আপনার অনুকূলে চলে আসবে।
প্রশ্ন : আমরা দুজনে একটা প্রতিষ্ঠান চালাই কিন্তু আমার পার্টনার মাঝে মাঝেই বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে তাকে চতুর মনে হয়। আমি বেরিয়ে যেতে চাইলে সে হাত-পা ধরা শুরু করে। এরকম বেশ কয়েকবার হয়েছে। অনেকে আমাকে আলাদা প্রতিষ্ঠান করতে বলে এবং আমি জানি তা আমি পারবো। আপনি বলে দিন-আমি কী করতে পারি?
উত্তর : ‘পার্টনার মাঝে মাঝেই বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে তাকে চতুর মনে হয়।’ তার মানে পার্টনারের প্রতি আপনার আস্থা নেই। এটা না হলে তো আপনি পার্টনারশিপ বিজনেস করতে পারবেন না। কারণ পার্টনারশিপটাই হচ্ছে আস্থা বা বিশ্বাসের ব্যাপার।
এ ব্যাপারে ‘বে-ইস্টার্ন’ গ্রুপের জাকি-মোশাররফ জুটি এক চমৎকার উদাহরণ। ৫০ বছর আগে প্রথম যখন শুনলাম জাকি মোশাররফ, আমি ভাবলাম ‘জাকি মোশাররফ’ মানে একজন। পরে যখন তাদের অফিসে গেলাম, দেখলাম-দুজন মানুষ। একজন জাকিউদ্দিন আহমেদ, আরেকজন মোশাররফ হোসেন। এত বিশ্বস্ত পার্টনারশিপ খুবই বিরল। একইসাথে ব্যবসা করছেন, যেখানে যান একসাথে যান। বাড়ি করেছেন, সেটাও পাশাপাশি এবং একই ডিজাইন। দাওয়াত করলেও দুজনকেই করতে হয়। কারণ একজনকে ছাড়া আরেকজন যান না। ১২ তম ব্যাচে দুজন একসাথে কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করেছেন। অর্থাৎ এটা হলো পার্টনারশিপ যে, আপনারা একে অপরকে সবকিছুতে সবসময়ই পাশে পাবেন। বিশ্বাস করতে পারবেন।
পার্টনারশিপ গড়ার আগেই আপনাকে চিন্তা করতে হবে-যাকে আমি পার্টনার করছি তার সাথে আমি চলতে পারবো কি না। কারণ, যাকে বিশ্বাস করতে পারবেন না তার সাথে আপনার ব্যবসা বেশিদিন চলবে না। আজ হলেও ভাঙবে, কাল হলেও ভাঙবে।
যৌথ ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হচ্ছে-আমরা এখনো সামন্তবাদী বা তালুকদারি দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করছি, সঙ্ঘের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতে পারছি না। আমরা মনে করি-আমি আমার মতন বুঝি, আমি চলবো আমার মতো। আর এর ফলেই আমরা বড় কিছু করতে পারি না।
অথচ দেখুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। ১৬০০ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হলো, তার দেড়শ বছর পর ১৭৫৭ সালে তারা এই উপমহাদেশ দখল করলো এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশের ক্ষমতা হারালো।
অর্থাৎ একটা কোম্পানি ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ১০০ বছর একটা উপমহাদেশ দখল করে থাকলো। কত প্রজন্ম এই কোম্পানি চলেছে আমরা খুব সহজে বুঝতে পারি। যারাই এই সঙ্ঘ-সংস্কৃতি অনুসরণ করেছে তারাই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক হয়েছে।
( চলবে )
#QuantumMethod
^
^
dearbangla24 = ব্যবসার মূল শর্ত, ব্যবসা, how to start new business, সফল ব্যবসার নিয়ম, ব্যবসা শুরুর কথা, উন্নতি, business, ব্যবসার সফলতা, ব্যবসার শর্ত, সফল ব্যবসার কথা, good business, উদ্যোক্তা হতে চাই, ব্যবসা সফল করতে, ব্যবসার নিয়ম, নতুন ব্যবসা, new business, উদ্যোক্তা,
No comments:
Post a Comment