বিশ্বখ্যাত ১২ উ‌দ্যোক্তার সফলতার গল্প

বিশ্বসেরা ১২ উদ্যোক্তাদের সফলতার পেছ‌নের কাহিনী। উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল ধারণার প্রবর্তন করে ব্যবসা-উদ্যোগের গতানুগতিক ধরন পাল্টে দিয়ে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন—এ রকম ১২ জন সেরা উদ্যোক্তার একটি তালিকা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইমের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরচুন। তালিকার ১২তম স্থানে আছেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস



১. স্টিভ জবস
তথ্যপ্রযুক্তি জগতের অন্যতম দিকপাল অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবস এই তালিকার প্রথম স্থানে আছেন। তিনি ছিলেন একাধারে স্বপ্নদর্শী, অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী, মেধাবী ও তেজস্বী এক উদ্যোক্তা। ব্যবসায়ে তাঁর অন্যতম পরামর্শ ছিল গ্রুপ বা গোষ্ঠী ও গবেষণাকে প্রাধান্য না দেওয়া। অ্যাপলের বার্ষিক পণ্য বিক্রির পরিমাণ ১০ হাজার ৮২০ কোটি ডলার এবং মোট সম্পদমূল্য ৫৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। অ্যাপলে বর্তমানে ৬৩ হাজার জনবল কর্মরত রয়েছেন। স্টিভ জবস মাত্র ৫৬ বছর বয়সে গত বছর মারা যান।
২. বিল গেটস
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম বিল গেটস তালিকাটির দ্বিতীয় স্থানে আছেন। ৫৬ বছর বয়সী বিল গেটস হলেন দুনিয়ার সেই সব অল্পসংখ্যক অসাধারণ উদ্যোক্তাদের একজন, যাঁরা নিজেদের জীবদ্দশাতেই দুবার বিশ্বকে বদলে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর কোম্পানির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ছয় হাজার ৯৯০ কোটি ডলার এবং মোট সম্পদমূল্য ২৭ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। মাইক্রোসফটে বর্তমানে ৯০ হাজার লোক কর্মরত রয়েছেন। বিল গেটসের ব্যবসায়িক পরামর্শ হলো, প্রতিটি স্মার্ট লোককে খুঁজে বের করুন এবং ছোট ছোট কর্মদল গঠন করুন। তিনি বিশ্বব্যাপী পারসোন্যাল কম্পিউটার (পিসি) ব্যবহারে বিপ্লব বয়ে আনেন। আর বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান জনস্বাস্থ্য ও জনশিক্ষায় যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবিলায় তিনি বিল অ্যান্ড মেলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ব্যাপক হারে দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
৩. ফ্রেডরিক স্মিথ
বিশ্বের অন্যতম লজিস্টিকস সেবাদানকারী কোম্পানি ফেডারেল এক্সপ্রেসের (ফেডেক্স) প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডরিক স্মিথ আছেন তৃতীয় স্থানে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ তিন হাজার ৯৩০ কোটি মার্কিন ডলার ও মোট সম্পদমূল্য তিন হাজার কোটি ডলার। ফেডেক্সে দুনিয়াজুড়ে বর্তমানে দুই লাখ ৫৫ হাজার ৫৭৩ জন কর্মী কাজ করছেন। ৬৭ বছরের ফ্রেড স্মিথের ব্যবসায়িক উপদেশ হলো, ‘প্রথম ধাপের ব্যবস্থাপকদের ওপরই নির্ভর করা।’
৪. জেফ বেজোস
বিশ্বের অন্যতম স্বাপ্নিক উদ্যোক্তা জেফ বেজোস তালিকায় চতুর্থ। ১৯৯২ সালে উদ্ভাবনী কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এবং ১৯৯৪ সালে গড়ে তোলেন বহুজাতিক ইলেকট্রনিক কমার্স কোম্পানি আমাজন ডটকম। আমাজনের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ চার হাজার ৮১০ কোটি ডলার ও মোট সম্পদমূল্য আট হাজার ৪০০ কোটি ডলার। ৪৮ বছর বয়সী বেজোসের প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ৫৬ হাজার ২০০ কর্মী কাজ করছেন।
৫. ল্যারি পেইজ ও সের্গেই ব্রিন
অনলাইন সার্চ ইঞ্জিন গুগলের দুই প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেইজ ও সের্গেই ব্রিন যুগ্মভাবে রয়েছেন ফরচুনের তালিকার পঞ্চম স্থানে। গুগলের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ তিন হাজার ৭৯০ কোটি ডলার ও মোট সম্পদমূল্য ২০ হাজার ৩২০ কোটি ডলার। এই কোম্পানিতে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৩২ হাজার ৫০০ লোক। তাঁদের ব্যবসায়িক পরামর্শ হলো ‘উদ্ভাবনের জন্য কোনো অনাবশ্যক ব্যয় করা যাবে না।’ বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন গুগলের মাধ্যমে আড়াই শ কোটি সার্চ করা হয়।
৬. হাওয়ার্ড শুলজ
বিখ্যাত কফি স্টারবাকসের হাওয়ার্ড শুলজ পেয়েছেন ষষ্ঠ স্থান। তাঁর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ এক হাজার ১৭০ কোটি ডলার ও মোট সম্পদের বাজারমূল্য চার হাজার কোটি ডলার। এই কোম্পানিতে বর্তমানে এক লাখ ৪৯ হাজার লোক কর্মরত। ৫৮ বছর বয়সী হাওয়ার্ড শুলৎজের ব্যবসায়িক পরামর্শ হলো, সব সময়ই পুরোনো উপায়েই চ্যালেঞ্জ করুন।
৭. মার্ক জুকারবার্গ
সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ওয়েবসাইট ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকার বার্গ পেয়েছেন ফরচুনের তালিকার সপ্তম স্থান। আগামী মে মাসে পালন করবেন ২৮তম জন্মদিন। তাঁর কোম্পানি ফেসবুকের বয়স হচ্ছে মাত্র আট বছর। ফেসবুকের বার্ষিক বাজারমূল্য্য ৩৭১ কোটি ডলার ও সম্পদের মোট বাজারমূল্য সাত হাজার ৫০০ কোটি থেকে ১০ হাজার কোটি ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৮. জন ম্যাকেই
তালিকার অষ্টম স্থান পেয়েছেন হোল ফুডসের প্রতিষ্ঠাতা জন ম্যাকেই, যিনি ১৯৭৮ সালে তাঁর তৎকালীন বান্ধবী রিনি লসনকে নিয়ে প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ এক হাজার ১০ কোটি ডলার এবং সম্পদের বাজারমূল্য এক হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ৫৬ হাজার ২০০ জনবল কর্মরত রয়েছেন। জন ম্যাকির পরামর্শ হলো ‘উদ্দেশ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।’
৯. হার্ব কেলেহার
সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইনসের হার্ব কেলেহার রয়েছেন নবম স্থানে। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর কোম্পানির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ এক হাজার ৫৬০ কোটি ডলার ও সম্পদের বাজারমূল্য ছয় হাজার ৪০০ কোটি ডলার। হার্ব কেলেহের প্রতিষ্ঠানে বর্তমান কর্মীসংখ্যা ৪৫ হাজার ৩৯২ জন। তাঁর ব্যবসায়িক পরামর্শ হলো, ‘আপনার ভোক্তা বা গ্রাহকদের ১ নম্বর করে তুলুন।’
১০. নারায়ণ মূর্তি
ইনফোসিসের নারায়ণ মূর্তি পেয়েছেন দশম স্থান। ভারতীয় এ নাগরিকের প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ৬০০ কোটি ডলার ও সম্পদের মোট বাজারমূল্য তিন হাজার ২০০ কোটি ডলার। তাঁর কোম্পানিতে বর্তমান এক লাখ ৪৫ হাজার লোক কর্মরত আছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, ভারতীয়রাও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম।
১১. স্যাম ওয়ালটন
ওয়াল-মার্ট স্টোরসের স্যাম ওয়ালটন আছেন একাদশ স্থানে। যাঁর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ৪৪ হাজার ৬৯০ কোটি ডলার ও সম্পদের বাজারমূল্য তিন হাজার ৬৫০ কোটি ডলার। এ কোম্পানির বর্তমান কর্মীসংখ্যা ২০ লাখ। স্যাম ওয়ালটনের পরামর্শ হলো, ‘জনগণ যেটা চায়, তাদের সেটাই দিন।’ প্রথম ওয়াল-মার্ট স্টোর প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পরে ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান।
১২. মুহাম্মদ ইউনূস
ফরচুনের তালিকায় ১২তম স্থানে রয়েছেন বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর পরামর্শ হলো, ‘ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।’ গত শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির তত্ত্ব পড়াতেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরের মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের পরিস্থিতি তাঁকে নাড়া দেয় এবং এসব স্থানীয় দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গ্রাম থেকে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেন।
এভাবে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে তিনি এ কার্যক্রম চালিয়ে যান। আর ১৯৮৩ সালে তিনি গড়ে তোলেন ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক। ব্যাংকটি এ পর্যন্ত সারা দেশের ৭৩ হাজার গ্রামের ৭০ লাখ দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ধারণা ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

No comments:

Post a Comment