নকশীকাঁথা বা কাপ‌ড়ের ব্যবসা

নকশীকাঁথা শিল্প

প্রেক্ষাপট: আবহমানকাল থেকেই বাংলার বধূরা স্বভাবগতভাবেই বাংলার ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দৃশ্যগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সূই-সূতার মাধ্যমে কাপড়ের উপর তৈরী করত অপূর্ব চিত্র। গ্রামের বৌ-ঝিরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে সৌখিনতাবশত: নকশীকাঁথা তৈরী করত। মেয়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে মা, নানী-দাদীরা মেয়েকে শুশুরবাড়ী পাঠানোর সময় বাহারী রঙ এর নকশীকাঁথা সঙ্গে দিত। যারা গরীব তারাও মেয়েকে ২/১টি  কাঁথা বালিশ দিতে ভুলত না।

নতুন কাপড়ের মধ্যে বাহারী নকশীকাঁথা দেয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। বাড়ীতে মেহমান আসলেই নানা রঙ্গের হাতের কাজের বিছানার চাঁদর, বালিশ, বালিশের কভার দস্তরখানা  ইত্যাদি ব্যবহার করতে দেয়া হত। এজন্যে গ্রামের বৌ-ঝিরা প্রতিটি বাড়ীতেই পরিধেয় পুরোনো শাড়ী লুঙ্গী একত্র করে অথবা কেটে কেটে কিংবা পাইর থেকে সূতা ছাড়িয়ে তা একত্রিত করে নিজস্ব স্বকীয়তায় মনের মাধুরী দিয়ে তৈরী করত নানাবিধ পোষাক পরিচ্ছদ। জামালপুরের নকশী কাঁথা ও হাতের কাজের বাহারী পোষাক পরিচ্ছদ সারাদেশে বহু পূর্ব থেকেই প্রশংসিত ছিল। বর্তমানে তা আরো উন্নত হয়ে দেশে ও দেশের বাইরে সমাধৃত হচ্ছে।
জামালপুরের বকশীগ্ঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ এবং সদর উপজেলাতেই নকশী কাঁথা শিল্পের কম বেশী উৎপাদন হয়। তবে  জামালপুর সদর উপজেলায় এ শিল্পের বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে জামালপুর শহরে এর প্রা‌প্তি সবচেয়ে বেশী লক্ষ্যনীয়। এখানকার  পোষাক পরিচ্ছদের গুনগতমান উন্নত হওয়ায় এবং দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় দেশ ও দেশের বাইরে এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমরা যদি পিছনের দিকে ফিরে তাকাই তবে দেখবো এ ঐতিহ্যবাহী মনোমুগ্ধকর সূচি শিল্পটি একসময় হারিয়ে যেতে বসেছিল। ৭০ দশকের শেষভাগে এ শিল্পের চিহ্ন প্রায় বিলুপ্ত হতে থাকে। অবশেয়ে ৮০ দশকের শুরুতেই আবার হারাতে বসা নকশী শিল্পটি পুনরুদ্ধার করে বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় গতিযোগ করে ব্র্যাক নামীয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানটি।  ব্র্যাক জামালপুরের বিভিন্ন গ্রামের  সূচী শিল্পীদের খুঁজে বের করে নকশী কাঁথা শিল্পের নব উত্থান ঘটায়। ১৯৮৭ সালে বেসরাকারী সংস্থা উন্নয়ন সংঘ এক হাজার  গ্রামীণ মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশী কাঁথার কার্যক্রম শুরু করে।

উন্নয়ন সংঘ থেকে অনেক প্রশিক্ষিত কর্মী বের হয়ে আসার পর তারা নিজেরাই প্রতিষ্ঠা করেন নকশীকাঁথা শিল্প। এ সময় গড়ে উঠে রং ধনু হস্ত শিল্প, সৃজন মহিলা সংস্থা, সুপ্তি, ক্যাম্প, কারু নিলয়, জোসনা হস্ত শিল্প, প্রত্যয় ক্রাফট, শতদল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান। পরবর্তী সময়ে এ ক্ষুদ্র শিল্পটি আরো  প্রসার লাভ করে। বর্তমানে জামালপুরে  সবগুলো উপজেলাতেই এ শিল্পের কাজ হচ্ছে এবং প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসবে মধ্যে  উল্লেখযোগ্য হ’ল আয়োজন, রওজা কারু শিল্প, কারু পল্লী, কারু নীড়, দোলন চাঁপা, ঝিনুক, সূচিকা., তরঙ্গ, দিপ্ত কুটির, বুণন, অণিকা, মিম, মামিম ইত্যাদি । এ শিল্পের সাথে জামালপুরের  প্রায় ৭৫ হাজার পুরুষ-মহিলা জড়িয়ে রয়েছে।

নানান প্রতিকূলতার কারণে শিল্পটির তেমন প্রসার ঘটেনি। বর্তমানে এ শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা আর্থিক অনটনে থাকায়  ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

উৎপাদিত পণ্যের বাজার: এখানকার উৎপাদিত পণ্যাদি ঢাকা, চট্রগ্রাম, ময়মনসিংহ, নারায়নগঞ্জ, রাজশাহী, কুমিল্লা, রংপুর, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের প্রায় সবগুলো জেলা শহরে কমবেশী বাজার সৃস্টি করতে পেরেছে। এ ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিযার অন্যান্য দেশসহ সারা বিশ্বের অনেক দেশেই এ পণ্য রপ্তানী হচ্ছে।

বাজারজাত করণ প্রক্রিয়াঃ স্থানীয় উদ্যোক্তারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মধ্যসত্বভোগীদের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে থাকে। এছাড়াও জামালপুর থেকে সরাসরি পণ্য বহন করে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার শো -রুম গুলোতে সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে এসএ পরিবহন ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত মালামাল সরবরাহ করা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত মেলাতেও এখানকার ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যাদি বিক্রি করে আসচ্ছে। এ সব প্রক্রিয়ায়  বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কিছুটা ঝুঁকি থাকে।

নকশীকাঁথা পণ্যের নাম ও দামসমূহঃ
নকশীকাঁথা শিল্পের জিনিষ পত্রাদির মধ্যে রয়েছে নকশীকাঁথা, বেড কভার, থ্রীপিছ, ওয়ালমেট, কুশন কভার, শাড়ী, পাঞ্জাবী, টি শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিজ পাঞ্জাবী, ইয়ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ীর পাইর, ওড়না, ফ্লোর কুশন, মাথার ব্যান্ড, মানি ব্যাগ, কলমদানী, মোবাইল ব্যাগ, ওয়ালমেট, ছিকা, শাল চাদর  ইত্যাদি। নকশীকাঁথা পণ্যের মূল্য ২৫ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

প্র‌য়োজনীয় কিছু টিপস্ঃ
আপনিও নকশি কাঁথার সাপ্লায়ারের ব্যবসা করতে পারেন। স্বল্প পুঁজিতে বাড়িতে বসেই আপনি আপনার ব্যবসা করতে পারবেন। কোন অফিস বা শোরুম এর দরকার হ‌বে না।

আপনাকে যেটা করতে হবেঃ প্রথমত- আপনি মূলত ডিলারশীপের কাজ করবেন। যেকোনো এক কাপড়ের দোকানের সাথে চুক্তি করে; তাদের চাহিদা অনুযায়ী নকশি কাঁথা সরবরাহ করবেন। অর্থাৎ আপনি নি‌জে সেলাই না ক‌রে মধ্যস্থতা করবেন। আর সেলাই করবে গ্রামের মহিলারা। আপনি শুধু মাঝে মাঝে খোঁজ রাখবেন।

একটা কাঁথা সেলায় এর মজুরি মাত্র ৩৫০/- আর কাঁথার কাপর আর নকশা প্রতি একপিচ পরবে ১১০০/- আপনি একটা কাঁথা কমপ‌ক্ষে ২০০০-২৫০০/- পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন।
এই বাবসায় রিক্স অনেক কম।

প্র‌শিক্ষণ জরুরীঃ বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার এর উদ্যোগে যুব উন্নয়ন বা মহিলা অধিদপ্তর অথবা অন্য যে কোন প্র‌তিষ্ঠান থেকে কাজ শিখুন, তারপর ব্যবসা করতে নামুন। ব্যবসা করতে আপনার টাকার থেকে অভিজ্ঞতা বেশি দরকার। তবে, আপনি হাতের কাজ যেমন, ব্লক, বাটিক এর কাজ করতে পারেন। এটাতে টাকা কম লাগে এবং মহিলা অধিদপ্তর থেকে সরকারের আর্থিক সহায়তাও পাবেন। এছাড়াও বি‌ভিন্ন ব্যাংক এসএমই লোন দি‌য়ে থা‌কে।

1 comment:

  1. নকশি কাঁথার ক্রয়ের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন

    ReplyDelete