উ‌দ্যোক্তা, তাই 'চাকরিটা আমি দিতে পারি বেলা শুনছ...।’

বরং নিজেই হই উদ্যোক্তা
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, সময় কিন্তু মানুষকে সব সময়ই সঠিক পথ দেখায়। সে পথকে চিনে নেওয়ার দায়িত্ব শুধু আপনার। হয়তো ভাবছেন, কী সব আবোল-তাবোল কথা! সময় আবার মানুষকে পথ দেখায় কীভাবে! তাহলে বলি, চোখ-কান খুলে আপনার চারপাশে একটু তাকান। হাজা‌রো উদাহরণ মিলবে। 

এই যেমন মাহমুদুল হাসান সোহাগ। বুয়েট থেকে তড়িৎকৌশল বিষয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে সময়ের দেখানো পথেই পা বাড়িয়েছেন। তাঁর মতে, ‘চাকরির পেছনে না ছুটে বরং নিজেই একটা কিছু করা এখন সময়ের দাবি।’ সেই দাবি মেটাতেই
মাহমুদুল হাসান গড়ে তুলেছেন অনলাইনভিত্তিক বই বিকিকিনির প্রতিষ্ঠান ‘রকমারি ডট কম’, সেই সঙ্গে ‘অন্য রকম সফটওয়্যার’, ‘অন্য রকম সলিউশন’, ‘অন্য রকম ওয়েব সার্ভিস’, ‘অন্য রকম প্রকাশনী’, সব মিলিয়ে মাহমুদুল হাসান গড়ে তুলেছেন ‘অন্য রকম গ্রুপ’, এখন তিনি সফল একজন উদ্যোক্তা।

রাজধানীর বাইরেও উদাহরণ আছে অসংখ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী আরাফাত রুবেলের কথাই ধরা যাক। পড়ালেখার পাট চুকানোর পর একদিনের জন্যও চাকরি খোঁজেননি আরাফাত, বরং নিজেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কাজে নেমে পড়েছেন।
নিজের ডিজাইনে তৈরি আসবাব দিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘আলমিরা’ নামের প্রতিষ্ঠান। এখন তাঁর আলমিরায় কর্মচারীর সংখ্যা শতাধিক। 

যশোরের মেয়ে তনুজা রহমান। যশোরে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন রঙ হ্যান্ডিক্রাফট। তনুজার এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কাজ করছে তিন হাজারের বেশি নারী কর্মী!

এ রকম উদাহরণ ছড়ানো রয়েছে সারা বাংলাদেশেই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, সময় এখন আপনাকে যে পথে হাঁটতে বলছে, সেই পথের নাম উদ্যোক্তা হওয়ার পথ। অতএব, ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ’-জাতীয় গানের রেওয়াজ বাদ দিয়ে বরং কণ্ঠে তুলুন এমন গান, ‘চাকরিটা আমি দিতে পারি বেলা শুনছ...।’

পুঁজি এবং প্রশিক্ষণ- জানি, প্রথমেই আপনার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যাবে এই ভেবে, উদ্যোক্তা যে হব, পুঁজি পাব কোথায়! পুঁজি মিলতে পারে নানা জায়গায়। সে ক্ষেত্রে দেখবেন নিজ পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনেরাই এগিয়ে এসেছেন আপনার সাহয্যে।
তা ছাড়া সরকারেরও রয়েছে এ বিষয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ। যেমন কর্মসংস্থান ব্যাংক। এখানে কেবল ব্যবসায়িক আইডিয়া, সাফল্যের সম্ভাবনা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ জমা দিলেই মিলবে স্বল্প কিংবা মাঝারি পরিমাণের পুঁজি। আরও আছে এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফের মতো প্রতিষ্ঠান, যারা স্বল্প বা মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ সংগ্রহের ব্যবস্থা করে দেয়। এ ব্যাপারে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ রেজওয়ানুল কবির জানালেন, ‘এসএমই ফাউন্ডেশন সাধারণত পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিকস পণ্য, রূপচর্চাকেন্দ্র, কৃত্রিম গয়না ও ফ্যাশন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যাপিং ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতে যাঁরা উদ্যোগ নিতে চান, তাঁদের আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে থাকে।’ এসব খাতের বাইরেও যাঁরা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আসেন, তাঁদের পরিকল্পনার কথাও শোনে এসএমই ফাউন্ডেশন। তারপর সেই খাতের সম্ভাবনা ও সমস্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে উদ্যোক্তার পুঁজি সংগ্রহের ব্যবস্থা করে দেয়। এসবের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে এসএমই ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকসহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে আছে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তার সুযোগ।
অবশ্য আপনি প্রতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ছাড়াও শুরু করতে পারেন। পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়তি উপার্জনের পথ খুঁজে নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিং আউট সোর্সের কাজ হতে পারে আপনার জন্য খুবই ভালো একটা মাধ্যম।

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) শিক্ষার্থী জুনাঈদ আহনাফ নির্ঝরকেই দেখুন না। ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটার গেমের প্রতি তাঁর দারুণ আকর্ষণ তাঁর। কীভাবে এসব গেম বানায়—এ নিয়ে স্কুল থেকেই তাঁর কৌতূহলের কমতি নেই। এসএসসির পর তাই বসে না থেকে নিজের চেষ্টাতেই শেখা শুরু করলেন প্রফেশনাল প্রোগ্রামিং। বগুড়া জিলা স্কুলের সেই কিশোর জুনায়েদ আহনাফ আজ পড়াশোনার পাশাপাশি প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করছেন ‘হুলু’ নামের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ইন্টারনেট-ভিত্তিক সংস্থায়। মূলত এইচএসসি শেষ করার পরপরই তিনি প্রফেশনাল প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। বয়স সবে ২০ পেরিয়েছে, কিন্তু এই বয়সেই তিনি হুলুর বাংলাদেশি ডেভেলপার। শখ, ঝোঁক আর পরিশ্রম একসঙ্গে হলে যেন কোনো বাধাকেই আর বাধা বলে মনে হয় না, এমনটাই মনে করেন তিনি।

চাই সৃজনশীলতা- যেকোনো উদ্যোগকে সফল করতে সর্বাগ্রে চাই সৃজনশীলতা। কে না জানে, সৃজনশীলতার অরেক নাম পরশপাথর। এই পরশপাথরের ছোঁয়া পেয়েছেন বলেই মাহমুদুল, আরাফাত, জুনাঈদ, তনুজারা হয়েছেন সফল। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য মাহমুদুলের পরামর্শ, ‘আপনার ভেতরের সৃজনশীলতার পরিচর্চা করুন। দেখবেন, আপনার সৃজনশীল উদ্যোগই আপনাকে পৌঁছে দিয়েছে সফলতার দ্বারপ্রান্তে।’ তারপরই সামাজিক যোগাযোগের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কথা বললেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। কেননা এই সামাজিক যোগাযোগই বাঁচিয়ে দেবে আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের খরচ। সে জন্য কাজে নেমে পড়ার প্রথম দিন থেকেই আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি ও বন্ধুবান্ধবদের জানাতে হবে আপনার উদ্যোগের কথা। এখন যেহেতু হাতের নাগালেই ইন্টারনেট, সেহেতু যোগাযোগ রক্ষা করা কিংবা নতুন বন্ধু তৈরি করা খুব সহজ ব্যাপার।
এরপর যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, জানা, বোঝা ও শেখা। একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য চারপাশ থেকে যেমন শিক্ষা নিতে হয়, তেমনি শিক্ষা নিতে হয় বই থেকেও। এমনটাই মনে করেন এই তরুণ উদ্যোক্তারা।

সমস্যা থেকেই সুযোগ- নতুন উদ্যক্তাদের জন্য আরাফাতের পরামর্শ হচ্ছে: যারা এখনও দোটানায় ভুগছেন, পারব কি পারব না, হবে কি হবে না, এত সমস্যা চারপাশে, যদি না সফল হই তাহলে ভবিষ্যতের কী হবে, তাদের জন্য বলছি, সমস্যা থেকেই একটি সফল উদ্যোগের জন্ম হয়। সমস্যাকে যিনি সুযোগে পরিণত করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত উদ্যোক্তা। সমস্যা আছে বলেই সবাই উদ্যোক্তা হতে পারে না, ভয়ে পিছিয়ে যায়। কিন্তু যারা সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে না দেখে সম্ভাবনার সূত্র মনে করেন, সফল উদ্যোক্তার বরণমালা তাদের গলায়ই শোভা পায়। তাই বলব, সাহস করে একবার শুরু করে দিন যেকোনো কিছু—সাফল্য ধরা না দিয়ে পারবেই না।
© Prothomalo

No comments:

Post a Comment